Questions? +1 (202) 335-3939 Login
Trusted News Since 1995
A service for global professionals · Monday, May 20, 2024 · 713,184,755 Articles · 3+ Million Readers

পশ্চিম মিয়ানমারে যুদ্ধ: রাখাইন-রোহিঙ্গা সংঘাত পরিহার

মিয়ানমারের সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর একটি আরাকান আর্মি (এএ) গত ছয় মাসে দেশটির পশ্চিম সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যের বেশিরভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, বিভিন্ন শহর ও সামরিক ঘাঁটি থেকে সরকারি সেনাদের বিতাড়িত করেছে। কিন্তু জাতিগত রাখাইন গোষ্ঠীর যোদ্ধাদের নিয়েই মূলত গঠিত এই বাহিনী রাখাইনের উত্তরে একটি জটিল এবং সম্ভাব্য বিধ্বংসী ত্রিমুখী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে যেটিতে রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ও যুক্ত। ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া সামরিক সরকার কিছু রোহিঙ্গাকে জবরদস্তি ও প্রলোভন উভয়ের মাধ্যমে নিজেদের পক্ষে নিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করেছে। যদিও আরাকান আর্মির লক্ষ্য একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গঠন করা, গোষ্ঠীটি বলছে, তারা সব সম্প্রদায়েরই শাসক হতে চায়। সংগঠনটির সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য এবং কর্মকাণ্ড রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ক্ষুব্ধ করেছে। এভাবে এই সংঘাত একটি বিপজ্জনক সাম্প্রদায়িক রূপ নিয়েছে। মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ রাখাইনদের একটি যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই চড়া মূল্য দিতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে উভয় সম্প্রদায়ের নেতাদের দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা উচিত- যেমন উস্কানিমূলক বক্তব্য পরিহার, নিপীড়ন থেকে সুরক্ষা দেওয়া, অতীত শত্রুতার ঊর্ধ্বে ওঠা এবং তাদের মধ্যে বিরোধ তৈরির সরকারের যে প্রচেষ্টা আরও শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ধরে রাখতে তা প্রত্যাখ্যান করা।

রাখাইনের সাম্প্রতিক লড়াই আরাকান আর্মি ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে তৃতীয় দফার যুদ্ধ। এর আগে দুই বছরের নৃশংস যুদ্ধ ২০২০ সালের নভেম্বরে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শেষ হয় এবং অল্প সময়ের জন্য হলেও ২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে তীব্র লড়াই ছড়িয়ে পড়ে। সামরিক বাহিনী দেশের অন্যান্য এলাকার লড়াইয়ে মনযোগ সরিয়ে নিলে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোতে আরাকান আর্মি অবস্থান সুসংহত করে, সেখানে নিজস্ব প্রশাসন গঠন করে এবং সামরিক সক্ষমতা জোরদার করে। ছয় মাস আগে এ গোষ্ঠীর শুরু করা বড় ধরনের হামলা ওই ভূখণ্ড উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে, তারা এখন মধ্য ও উত্তরাঞ্চলের নয়টি সম্পূর্ণ শহরের পাশাপাশি বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বেশির ভাগ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। আরাকান আর্মি খুব শিগগিরই রাখাইনের রাজধানী সিত্তের পাশাপাশি আরও দক্ষিণে অবস্থিত সামরিক বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ড সদরদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে।

আরাকান আর্মি অসাধারণ দ্রুততার সঙ্গে দেশটিতে কার্যত জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত বৃহত্তম ক্ষুদ্র রাষ্ট্র গঠন করেছে, যেখানে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস করে। রাখাইনের অনেক বাসিন্দা গোষ্ঠীটিকে নেপিডোর শাসন থেকে তাদের মুক্তিদাতা হিসেবে দেখছে। তারা মনে করে, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের উন্নয়ন না করে সবসময় শোষণ করে আসছে। কিন্তু এই দ্রুত সম্প্রসারণ কিছু ঝুঁকিও তৈরি করেছে, এর মধ্যে রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইন এবং সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের বিষয়টিও।

২০২৩ সালের নভেম্বরের আগে এসব সম্পর্কের ক্ষেত্রে উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। রাখাইন রাজ্য মিশ্র শাসনের অধীনে ছিল, আরাকান আর্মি মধ্য ও উত্তরাঞ্চলজুড়ে গ্রামীণ এলাকাগুলো নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল আর সামরিক বাহিনী বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজেদের ঘাঁটি এবং শহুরে এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। চলাচলে এবং অন্যান্য বিধিনিষেধ তুলে দিয়ে, রোহিঙ্গাদের প্রশাসনের নিম্ন পর্যায়ে চাকরি দিয়ে এবং সাধারণভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইনদের সঙ্গে পারস্পরিক যোগাযোগে উৎসাহিত করার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করেছিলেন আরাকান আর্মির নেতারা। রাখাইন জনগণের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের পরিবর্তে তার সমর্থকদের হতাশাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজদের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে, যারা ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার এবং সামরিক বাহিনী উভয়টি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।

যাইহোক, সাম্প্রতিক এই বিজয়ের অর্থ হলো এই গোষ্ঠীটি এখন রোহিঙ্গাদের বসবাসের প্রায় সব এলাকা দখলে নিয়েছে বা দখলের পথে রয়েছে, পাশাপাশি সেসব এলাকাও যেখানে ২০১৭ সালে এই সম্প্রদায়ের ওপর সামরিক বাহিনীর দমনপীড়নের সময় পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গার ফেরার সম্ভাবনা রয়েছে যদি সে পরিবেশ তৈরি হয়। এটা কোনভাবেই পূর্বনির্ধারিত নয় যে, বাস্তবের এসব পরিবর্তনের ফলে নিজেরাই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিপজ্জনক নতুন বিবাদ সৃষ্টি করবে। যদিও কিছু রোহিঙ্গা এসব ঘটনা সতর্ক দৃষ্টিতে দেখছে, তবে এমন কোনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটেনি যা রাখাইন রাজ্যের সাম্প্রতিক ইতিহাসে কোনো ক্ষতের সৃষ্টি করেছে- বিশেষ করে ২০১২ সালে যখন রাখাইন ও রোহিঙ্গা উভয় সম্প্রদায়ের কয়েক শ লোক নিহত হয়েছিল এবং প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল যাদের বেশির ভাগই রোহিঙ্গা মুসলিম। বিগত কয়েক বছর ধরে আন্ত:সাম্প্রদায়িক সম্পর্কোন্নয়নের জন্য আরাকান আর্মির প্রচেষ্টা সম্প্রতি মারাত্মক চাপের মধ্যে পড়েছে।

এই টানাপোড়েন মূলত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ডের কারণে, এর মধ্যে রয়েছে ব্যাপকভাবে সেনা সংগ্রহ অভিযান। সামরিক সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইং ১০ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করেন, সরকার একটি নিষ্ক্রিয় সেনা নিয়োগ আইন পুনরুজ্জীবিত করেছে, যার অধীনে দেশের সকল তরুণ নারী-পুরুষকে বাধ্যতামূলক সামরিক পরিষেবায় অংশ নিতে হবে। ব্যাপকভাবে ধিকৃত এ সরকারের হয়ে লড়াইয়ে অংশ নেওয়া এড়াতে মিয়ানমারের অন্যান্য অংশে লাখো তরুণ বিদেশে বা সামরিক সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা এলাকাগুলোতে পালিয়ে গেছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের যাওয়ার জায়গা নেই বললেই চলে। যদিও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে আসছে, এর মধ্যে রয়েছে তাদের অধিকাংশেরই নাগরিকত্ব প্রদানে অস্বীকৃতি এবং চলাচলের স্বাধীনতা সীমিত করা, তবু তাঁদেরকে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে কামানের খোরাক (খরচযোগ্য ধরে নিয়ে যেসব সেনাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় শত্রুর সামনে ঠেলে দেওয়া হয়) হিসেবে ব্যবহার করতে সামরিক বাহিনীর কোনো দ্বিধা নেই। রাখাইনে আরও সম্ভাব্য পরাজয়ের মুখে থাকা সরকার রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের গ্রামগুলো থেকে রোহিঙ্গা পুরুষদের সেনা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে, যেখানে এখনো রোহিঙ্গারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। রাজধানী সিত্তের নিকটবর্তী বন্দীশিবিরিগুলো থেকেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যেখানে ২০১২ সালের সহিংসতায় জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হওয়া প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার এখনো বসবাস করছে।

আরাকান আর্মি বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মংডু ও বুথিডং শহরে তাদের হামলা জোরদার করায় সামরিক বাহিনী এই নিয়োগ আরও বাড়িয়েছে। যদিও সঠিক পরিসংখ্যান নিশ্চিত করা কঠিন, বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার কারণে, এখন কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে মিলিশিয়া সদস্য হিসেবে কাজ করছে। এই নিয়োগের বেশিরভাগই যদিও জোরপূর্বক দেওয়া হয়েছে, কিছু রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় এই একই সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়েছে, যে বাহিনী ২০১৭ সালে তাদের প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার জনকে নির্মম কায়দায় প্রতিবেশী বাংলাদেশে তাড়িয়েছিল। এই সামরিক অভিযানকে যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে গণহত্যা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। আরাকান আর্মির প্রতি তাদের ভয় ও ক্রোধ এ ক্ষেত্রে কাজ করেছে বলে মনে হচ্ছে, তবে সরকার তাদেরকে নিয়মিত মজুরি দেওয়ার সম্ভাবনা এবং কিছু ক্ষেত্রে অন্তত নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতির মুলা ঝুলিয়েছে বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সামরিক বাহিনীর ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী নেতারাও তরুণদের সেনা হিসেবে নাম লেখাতে উৎসাহিত করে আসছেন।

নিজের প্রতিপক্ষকে অস্থিতিশীল করতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা উস্কে দেওয়ার প্রচেষ্টায় সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে এবং রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বিশেষ করে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে (আরসা) সহযোগিতা করতে বাধ্য করেছে। এই সংগঠনটির হামলার অজুহাত দেখিয়ে ২০১৭ সালের দমনপীড়ন চালানো হয়েছিল এবং এটিকে দীর্ঘদিন ধরে ‘সন্ত্রাসী সংগঠনের’ তালিকায় রেখেছে সামরিক বাহিনী।

এসব ঘটনা আরাকান আর্মির শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বকে স্পষ্টতই ক্ষুব্ধ করেছে। মার্চের শেষের দিকে গোষ্ঠীটি সতর্ক করে বলছেলি, ‘রাখাইনের বাঙালি জনগোষ্ঠীর’ যাদেরকে সেনা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদেরকে সরকারের সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং ‘আক্রমণ করা’ হবে। ‘বাঙালি’ শব্দ ব্যবহারকে রোহিঙ্গারা গালি হিসেবে দেখেন এবং দীর্ঘদিন ধরে তাদের নাগরিকত্বের দাবিগুলো দুর্বল করার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ এটি বোঝায়, তারা বাংলাদেশ থেকে আসা সাম্প্রতিক অভিবাসী। ‘বাঙালি’ শব্দ ব্যবহার করায় সমালোচনার জবাবে আরাকান আর্মির নেতা থন ম্রাট নইং আরও জোর দিয়ে বলেন, বাঙালিকে ‘বাঙালি’ বললে দোষের কিছু নেই। এরপর থেকে নেপিডোর অনুকরণ করে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে ‘বাঙালি মুসলিম সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ হিসেবে উল্লেখ করে আসছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনামূলক সৌহার্দ্যপূর্ণ সুর থেকে সরে এসেছে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধ অভিযান চালানোর ন্যায্যতা দিতে নেপিডো এই নাম ব্যবহার করেছিল। সম্প্রতি বুথিডং-এ গোষ্ঠীটির হাতে বন্দী হওয়া রোহিঙ্গা যোদ্ধাদের নিয়ে উপহাস করেছেন থন ম্রাট নইং। একই সময়ে এই গোষ্ঠীর মুখপাত্র দাবি করেছেন, সামরিক বাহিনীতে রোহিঙ্গাদের যোগদান ‘সম্প্রতি যারা গণহত্যার শিকার হয়েছেন এবং যারা স্বৈরাচার থেকে মুক্তির জন্য লড়াই করছেন, তাদের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা’।

এই অস্থির পরিবেশের মধ্যে বেসামরিক নাগরিকদের নির্যাতনের অভিযোগ ছড়িয়ে পড়ছে যা উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়াচ্ছে। গত ১১ এপ্রিল বুথিডংয়ে দুই রাখাইন পুরুষের গলাকাটা মরদেহ পাওয়া যায়। পরের কয়েক দিন রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা সম্ভবত সরকারের নির্দেশে রাখাইনদের কয়েক শ বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় যারা ইতিমধ্যেই শহরটি ছেড়ে পালিয়েছে। এরই মধ্যে ১৭ এপ্রিল মংডুর পশ্চিমে একটি গ্রাম থেকে পাঁচ রোহিঙ্গা পুরুষ নিখোঁজ হন, যেটি আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে ছিল। বাসিন্দারা বলেছেন, আরাকান আর্মির যোদ্ধাদের সঙ্গে ওই পুরুষদের শেষবার দেখেছিলেন। কিন্তু পাঁচ দিন পর যখন তাঁদের মরদেহ পাওয়া যায়, তখন তাদের হত্যার দায় রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেয় আরাকান আর্মি। এরপর মে মাসের শুরুর দিকে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মিলে লড়াই করা রোহিঙ্গা যোদ্ধারা মংডুর পশ্চিমে দুটি রাখাইন গ্রামে অভিযান চালিয়ে বেশকিছু বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় এবং তরুণ বয়সী এক মাকে হত্যা করে। আরাকান আর্মির বিরুদ্ধেও এর শাসনাধীন এলাকাগুলোতে জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের যোদ্ধা হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে যদিও সামরিক বাহিনীর তুলনায় এ সংখ্যা অনেক কম। এগুলো এবং অধিকার লঙ্ঘনের অন্যান্য অভিযোগ, এ মধ্যে অনেকগুলোই যাচাই করা কঠিন, বিশেষ করে উত্তর রাখাইনে ইন্টারনেট বন্ধের কারণে, রোহিঙ্গা নেতাদের আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ বা এমনকি ২০১৭ সালে সামরিক বাহিনীর চালানো নৃশংসতার মতো ঠিক একই ধরনের ‘দ্বিতীয় দফার গণহত্যার’ অভিযোগ আনতে প্ররোচিত করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রোহিঙ্গারা ক্রমবর্ধমানভাবে আরাকান আর্মিকে ‘মগ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ বলে অভিহিত করছে। ‘মগ’ রাখাইনদের কাছে একটি অবমাননাকর শব্দ।

এসব উস্কানিমূলক ভাষা ব্যবহার সামরিক বাহিনী এবং রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো উভয়কেই নতুন যোদ্ধা সংগ্রহে সাহায্য করেছে, বাংলাদেশের শরণার্থীশিবিরগুলোতেও এটা ঘটছে। বিশেষ করে, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন শরণার্থীশিবিরে তাদের সদস্য সংগ্রহ জোরদার করেছে, বাসিন্দাদের বলছে, উত্তর রাখাইনকে ‘মুক্ত করার’ এখনই সময়। শরণার্থীশিবিরের সূত্রগুলো ক্রাইসিস গ্রুপকে বলেছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কয়েক হাজার ভবিষ্যৎ যোদ্ধা সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমারে প্রবেশ করেছে, যাদের মধ্যে ১৪ বছরের শিশুও রয়েছে। এই যোদ্ধা সংগ্রহ অভিযান সাম্প্রতিক দিনগুলোতে নাটকীয়ভাবে বেড়েছে, প্রায় ৫০০ শরণার্থী তালিকাভুক্ত হয়েছেন। যদিও কিছু রোহিঙ্গা স্বদেশের জন্য লড়াই করার আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে, বেশির ভাগকেই তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপ দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই জোরপূর্বক নিয়োগ শরণার্থীশিবিরগুলোতে প্রকাশ্যে ঘটছে এবং অনেক শরণার্থীকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়ার মতো আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এটি বন্ধে তেমন কিছু করছে না বললেই চলে।

সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আরাকান আর্মি উত্তর রাখাইনে হামলার পরিধি বাড়িয়েছে, বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা দখলে নিয়েছে। এটি প্রায় নিশ্চিত বলে মনে হচ্ছে, সামনের সপ্তাহ এবং মাসগুলোতে গোষ্ঠীটি মংডু ও বুথিডং উভয়েরই নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করবে, এই দুটি শহর যেখানে রাখাইন রাজ্যে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের বেশ বড় অংশ বাস করে। তবে তারা সামরিকভাবে যখন সফল হবে, গোষ্ঠীটি যদি নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় শান্তি সুসংহত করার আশা নিয়ে এই যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসতে চায়, তাহলে তাদেরকে সাবধানে পা ফেলতে হবে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীই যখন অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে উত্তর রাখাইনে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে দিয়েছে আর তারাই সবচেয়ে সহজে তা প্রশমতি করতে পারে, তবে তারা তেমনটা করবে বলে মনে হয় না। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের পাশাপাশি আরাকান আর্মির নেতিবাচক বিবৃতি ইতিমধ্যেই তৈরি হওয়া উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এখনই আস্থা ফেরানো শুরু করা দরকার, যাতে তারা যদি উত্তর রাখাইন থেকে সামরিক সরকারকে তাড়িয়ে দিতে সফল হয়, যেমনটি এখন খুবই সম্ভব মনে হচ্ছে, গোষ্ঠীটি এমন একটি রোহিঙ্গা বিদ্রোহের মুখে পড়বে না যা আর যাইহোক

‘বাঙালি‘ শব্দের ব্যবহার বাদ দেওয়া এবং আরও স্পষ্টভাবে রোহিঙ্গাদের অধিকারের ক্ষেত্র বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা যা মিয়ানমার রাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে- যেমন চলাচলের স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক অধিকার এবং আবশ্যিক পরিষেবাগুলো পাওয়া এ ক্ষেত্রে একটি ভালো সূচনা হতে পারে। রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিকদের সরকারের প্রতিশোধের হুমকি থেকে বাঁচাতে আরাকান আর্মির আরও উচিত রোহিঙ্গা গ্রামগুলোকে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার পরিহার করা। এ ছাড়া আরাকান আর্মির উচিত নিজ সেনাদের জন্য একটি সুস্পষ্ট আচরণবিধি ঘোষণা করা, নিজ বাহিনী দ্বারা সংঘটিত অন্যায়ের বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগের তদন্ত করার অঙ্গীকার করা এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট, দৃশ্যমান ও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে আরও ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য গোষ্ঠীটির উচিত আরও বেশি রোহিঙ্গাকে উচ্চপর্যায়েসহ তাদের প্রশাসনে একীভূত করা।

নিজেদের গতিপথ ঠিক করার ক্ষেত্রে আরাকান আর্মিকে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অভিযানের কারণে রাখাইন রাজ্যে অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে গভীর আন্তর্জাতিক মনযোগের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এই গভীর পর্যবেক্ষণের মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তদন্ত, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগের চলমান বিচার। এই আদালত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্য তাৎক্ষণিক কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মিয়ানমারের জন্য স্বাধীন তদন্ত প্রক্রিয়ার মতো জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন, এটি অপরাধীর সংশ্লিষ্টতা বা দাপ্তরিক সক্ষমতা নির্বিশেষে মিয়ানমারে সংঘটিত গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধের প্রমাণ সংগ্রহে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। যদি আরাকান আর্মিকে নিপীড়নের সঙ্গে জড়িত দেখানো হয়, তাহলে তাদের আইনি দিক এবং অবস্থান উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেটি গোষ্ঠীটির শাসিত এলাকার রোহিঙ্গাদের সঙ্গেই কেবল নয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর সঙ্গেও।

আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গা বিশিষ্টজনদের মধ্যে সংলাপ ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। যদিও ঐক্যবদ্ধ রোহিঙ্গা নেতৃত্বের অনুপস্থিতি বিষয়গুলোকে জটিল করে তুলেছে, আরাকান আর্মির কমান্ডারদের উচিত উভয় পক্ষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস কাটিয়ে উঠতে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত সংলাপের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ এই সংলাপ আয়োজন করতে পারে। এটি আয়োজনের যথেষ্ট স্বার্থও রয়েছে, কারণ দেশটি চায় আশ্রয় দেওয়া ১০ লাখের বেশি শরণার্থী একদিন রাখাইনে ফিরে যেতে সক্ষম হবে, যা অদূর ভবিষ্যতে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণাধীন থাকতে পারে। শরণার্থীশিবির থেকে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সদস্য সংগ্রহ ঠেকাতে ঢাকা ও এর আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর উচিত তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং তাদের তহবিল ও অস্ত্রের উৎসগুলো বন্ধে কাজ করা। শরণার্থী সংকট বা এখনো দেশটির ভেতরে থাকা রোহিঙ্গাদের দুর্দশা- কোনোটিরই জবাব একটি রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী নয়।

রোহিঙ্গা নেতারা আরও সহিংসতা এড়াতে যে ভূমিকা পালন করতে পারেন, এর মধ্যে রয়েছে সম্প্রদায়ের সদস্যদের অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করা, যেখানে একটি বিকল্প রয়েছে। যাইহোক, প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ডের শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকায় রাখাইন এবং বাংলাদেশ উভয় জায়গায় সম্প্রদায়ের নেতারা প্রায়শই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো উভয়টিসহ সশস্ত্র পক্ষগুলোর বিরুদ্ধে নিরাপদে কথা বলতে অক্ষম। এ ক্ষেত্রে প্রবাসীরা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে এবং তারা এ সংঘাতকে কীভাবে দেখছেন সে বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ তারা বড় চিত্রটি মনে রাখবেন– আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলার সম্ভাবনা এখনো রয়েছে যখন সামরিক বাহিনী সংঘাত উস্কে দিচ্ছে এবং তারা রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে কীভাবে কথা বলে, সেইসঙ্গে কীভাবে তারা সম্ভাব্য উস্কানিমূলক তথ্য অনলাইনে তুলে ধরছে তা সাবধানতার সঙ্গে বিবেচনা নেওয়া।

আরাকান আর্মি অগ্রসর হচ্ছে আর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাদের থামানোর জন্য সম্ভাব্য সব হাতিয়ার ব্যবহারের চেষ্টা করছে; রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ভাগ্য সুতোয় ঝুলছে। যদি একটি রোহিঙ্গা বিদ্রোহের সূচনা হয়, বিশেষ করে একটি শক্তিশালী জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এটি কেবল সম্প্রদায়গুলোকে আরও রক্তপাত ও দুর্দশার দিকেই ঠেলে দিতে পারে যা উভয়ই অনেক বেশি দেখে আসছে। পক্ষগুলোর এখনো খাদের কিনারা থেকে সরে আসার সুযোগ রয়েছে। যাদের প্রভাব আছে তারা তেমনটিই করবেন সেটা নিশ্চিতে তাদের কাজ করে যাওয়া উচিত।

আরাকান আর্মি অগ্রসর হচ্ছে আর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাদের থামানোর জন্য সম্ভাব্য সব হাতিয়ার ব্যবহারের চেষ্টা করছে; রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ভাগ্য সুতোয় ঝুলছে। যদি একটি রোহিঙ্গা বিদ্রোহের সূচনা হয়, বিশেষ করে একটি শক্তিশালী জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এটি কেবল সম্প্রদায়গুলোকে আরও রক্তপাত ও দুর্দশার দিকেই ঠেলে দিতে পারে যা উভয়ই অনেক বেশি দেখে আসছে। পক্ষগুলোর এখনো খাদের কিনারা থেকে সরে আসার সুযোগ রয়েছে। যাদের প্রভাব আছে তারা তেমনটিই করবেন সেটা নিশ্চিতে তাদের কাজ করে যাওয়া উচিত।

Powered by EIN Presswire
Distribution channels: Politics


EIN Presswire does not exercise editorial control over third-party content provided, uploaded, published, or distributed by users of EIN Presswire. We are a distributor, not a publisher, of 3rd party content. Such content may contain the views, opinions, statements, offers, and other material of the respective users, suppliers, participants, or authors.

Submit your press release